প্রকাশকালঃ 2025-10-07 20:06:21

দেশজুড়ে জমি বিক্রয় ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন এনেছে সরকার। এখন থেকে অংশীদারভিত্তিক বা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত কোনো জমি আপোষ-মীমাংসা ছাড়া বিক্রি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশিত এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, যতদিন পর্যন্ত জমির অংশীদাররা নিজেদের মধ্যে আনুষ্ঠানিক বণ্টননামা দলিল সম্পন্ন না করবেন, ততদিন কেউ এককভাবে সেই জমি বিক্রি করতে পারবেন না।
সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে দেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা ও মৌজায় নতুন আইন কার্যকর হয়েছে। অর্থাৎ এখন থেকে কোনো ব্যক্তি তার উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমি বিক্রি করতে চাইলে, প্রথমে অংশীদারদের সঙ্গে আপোষে একটি বণ্টননামা দলিল বা বাটোয়ারা চুক্তি সম্পন্ন করতে হবে। অন্যথায় বিক্রয়, রেজিস্ট্রেশন ও নামজারি—সব প্রক্রিয়াই নিষিদ্ধ থাকবে।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক ও ভূমি মন্ত্রণালয় যৌথভাবে এই বিষয়ে বিস্তারিত নির্দেশনা দিয়েছে। প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, কেউ বেআইনিভাবে জমি বিক্রির চেষ্টা করলে বা ঘুষের মাধ্যমে সাব-রেজিস্ট্রারের কাছ থেকে রেজিস্ট্রেশন করালেও সেই জমির নামজারি করা যাবে না। এমনকি যদি কোনো এসিল্যান্ড অন্যায়ভাবে নামজারি করে ফেলেন, আদালতের রায় অনুযায়ী সেটি পরবর্তীতে বাতিল হয়ে যাবে।
এই বিধান কার্যকর হয়েছে ২০২৩ সালের “ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন”-এর ধারাবাহিকতায়। আগের সরকারের সময় এই আইন বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হলেও ভূমিদস্যু ও স্বার্থান্বেষী মহলের বাধায় তা থেমে যায়। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরই আইনটি কার্যকর করার ঘোষণা দেয় এবং ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে আনুষ্ঠানিক প্রজ্ঞাপন জারি করে দেশব্যাপী তা বাস্তবায়ন শুরু করে।
নতুন আইনে বলা হয়েছে— কোনো উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত বা যৌথ মালিকানাধীন সম্পত্তি অংশীদারদের লিখিত সম্মতি ছাড়া বিক্রি করা হলে, সেই বিক্রয় অবৈধ হিসেবে গণ্য হবে। ক্রেতাও সেই জমির বৈধ মালিকানা স্থায়ীভাবে অর্জন করতে পারবে না।
তবে এককভাবে জমি বিক্রির বৈধ পথও খোলা রাখা হয়েছে। কোনো মালিক যদি একা জমি বিক্রি করতে চান, তাহলে তাকে অংশীদারদের সঙ্গে আপোষে বণ্টননামা দলিল করতে হবে। আপোষ সম্ভব না হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আদালতে বাটোয়ারা মামলা (Partition Suit) দায়ের করতে পারবেন।
এই মামলার জন্য প্রয়োজন হবে মাত্র তিনটি নথি—
1️⃣ ওয়ারিশান সনদ (ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা পৌর মেয়রের কাছ থেকে)।
2️⃣ রেকর্ড খতিয়ান বা দলিল, যা মালিকানা প্রমাণ করবে।
3️⃣ খাজনা প্রদানের দাখিলা ও জাতীয় পরিচয়পত্র (NID)।
এই কাগজগুলোসহ একজন অভিজ্ঞ আইনজীবীর মাধ্যমে মামলা করলে আদালত দ্রুত নিষ্পত্তি করবে। আদালত প্রয়োজনে সরকারি আমিন বা সার্ভেয়ার পাঠিয়ে জমির বাস্তব অবস্থার ভিত্তিতে সুষম বণ্টন নিশ্চিত করবে। রায় অনুযায়ী প্রতিটি অংশীদারের নামে আলাদা মালিকানা নির্ধারিত হবে এবং তারা পরবর্তীতে নামজারি করতে পারবেন।
একবার আদালতের মাধ্যমে বণ্টন সম্পন্ন হলে অন্য কোনো ওয়ারিশ বা অংশীদার তাতে আপত্তি জানাতে পারবে না। আদালতের প্রদত্ত রায়ই চূড়ান্ত ও কার্যকর গণ্য হবে।
ফলে এখন থেকে বণ্টননামা ছাড়া জমি বিক্রি করলে সেই জমির রেজিস্ট্রেশন বা নামজারি কোনোভাবেই বৈধ হবে না। ক্রেতাও স্থায়ীভাবে জমির মালিকানা ধরে রাখতে পারবে না। কিন্তু যিনি আইন অনুযায়ী বণ্টননামা দলিল বা আদালতের রায় অনুযায়ী বাটোয়ারা মামলা সম্পন্ন করবেন, তিনি নিশ্চিন্তে জমি বিক্রি করতে পারবেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারের এই উদ্যোগ দীর্ঘদিন ধরে চলমান পারিবারিক জমি বিরোধ, প্রতারণা ও ভূমিদস্যুতা রোধে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে।